সোমবার, ৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পিতৃতন্ত্রের অভিধানেই নারীর সৌন্দর্য শাড়িতে


আমি খুব অবাক হ‌ইনি শাড়ির সপক্ষে উৎকট স‌ওয়াল দেখে। বিদগ্ধ অধ‍্যাপক হলেই যে তাঁর মানসিকতা হাস‍্যকর চিন্তাভাবনা হতে মুক্ত হবে, এ আশা আমি অন্তত করিনে। শাড়িতেই বাঙালী মেয়েদের সবচাইতে সুন্দর লাগে, এই ধারণা একটি পিতৃতান্ত্রিক শ‍্যুগারকোট, এ থেকে হারু নাপিতের‌ও যেমন মুক্তি নেই, অধ‍্যাপক সাহেবের‌ও নয়, ক্ষেন্তি জ‍্যেঠিমার‌ও নয়!

শাড়ি তো একটি পোশাকমাত্র, এটা কি নারীর আইডেনটিটি? তাহলে কী ভেবে অধ‍্যাপক মহোদয় নারীর বুদ্ধিমত্তার সাথে শাড়ি পরা না পরাকে কানেক্ট করে ফেললেন? আমরা সবসময়েই দেখে আসছি, নারীর পোশাক নিয়েই যতো হাহাকার! বাঙালী পুরুষ ধুতি পাঞ্জাবী না পরে জিনস টিশার্ট পরে দুনিয়া চষে ফেললেও তাদের বাঙালীত্ব বিন্দুমাত্র খর্ব হয় না, সেখানে বাঙালী মেয়ে শাড়ি ছেড়ে অন‍্য পোশাক পরলেই তাদের বাঙালীত্ব একেবারে ধুয়েমুছে একাকার হয়ে যায়। সাংস্কৃতিক পিসেমশাইগণ বেত হাতে রে রে করে তেড়ে আসেন। কেননা তাঁরা ভার্ডিক্ট দিয়েই রেখেছেন যে বাঙালী মেয়ের সৌন্দর্য হলো তার শাড়ি, তার পোশাক , তার চামড়ার রঙ! মেয়ে যতোই ব‍্যক্তিত্বহীন হোক, বুদ্ধিহীন হোক, মেধাশূন‍্য হোক, ডাজন্ট ম‍্যাটার্স, ওনলি শাড়ি ম‍্যাটার্স!

 

শাড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ পোশাক -অধ‍্যাপক ভার্ডিক্ট দিয়েছেন। বলি, এটি ঠিক করে দেবার অথরিটি কে দিলো আপনাকে মান‍্যবর? টাইট টিশার্টে সলমন খান নাকি ধুতি পাঞ্জাবিতে উত্তমকুমার, কার যৌন আবেদন অস্বীকার্য? ঠিক তেমনি ক‍্যারি করতে পারলে মিনিস্কার্ট হোক কি শাড়ি, আবেদন সবেতেই ফুটে উঠবে। তাছাড়া যৌনাবেদনময়তা কেবল পোশাকে থাকেনা হে মহামহিম! একজন মানুষ যদি বিন্দুমাত্র দেখতে “তথাকথিত ভালো” নাও হন, চেহারা গাত্রবর্ণ উচ্চতা ইত‍্যাদিতে আকর্ষণীয় নাও হন , তিনি কিন্তু তাঁর ব‍্যক্তিত্বপূর্ণ আচরণ, মেধাদীপ্ত উপস্থাপন, ব‍্যবহারের সৌন্দর্যের মাধ‍্যমে যৌনাবেদনময় লাগতে পারেন! ভুলে যাবেন না , যৌনাবেদনময় লাগার বিষয়টিও যথেষ্ট‌ই আপেক্ষিক!

শাড়ি পরলে খর্বকায় নারীকে দীর্ঘকায় লাগবে, এহেন “বিজ্ঞানভিত্তিক”(!) সমীকরণ কোন গাছ থেকে পেড়ে আনা হলো জানিনে। ভার্টিক‍্যাল লাইন বা লম্বরৈখিক পোশাকে খানিক খর্বতা ম‍্যানেজ দেয় বলে শুনেছিলাম কিন্তু এহেন কথাবার্তা জীবনে শুনিনি! ফ‍্যাশান পেশাদাররা ভালো বলতে পারবেন!

শাড়ি নাকি কতটুকু শরীর অনাবৃত রাখলে রহস‍্যময় দেখতে লাগবে তার পরাকাষ্ঠা, অর্থাৎ শাড়ি পরলে শরীরের অংশবিশেষ যে অনাবৃত রাখতেই হবে ওঁদের “চোখের তৃপ্তির” জন‍্য, এই রায়‌ও দিয়ে ফেলেছেন। শরীরের এতটুকুও অনাবৃত না রেখেও শাড়ি পরা যায়, পরা হয়। তো, সেই পরাটা তাহলে অসুন্দর, কেমন! তথাকথিত রহস‍্য নেই, এজন‍্য? এছাড়াও শাড়ি শালীন ও রুচিসম্মত…. আলাদা করে এটা বলার প্রয়োজনটা? অর্থাৎ বাকি পোশাক সব অশালীন, অরুচিকর? পোশাক কি কোনো শাস্ত্র? তার শালীন অশালীন কোন টোলে নির্ধারিত হয়? এসব মন্তব‍্যগুলো থেকে কী ভীষণ পচা দুর্গন্ধ বেরোয়!

বাঙালী মেয়েদের শাড়ি ছাড়া কিছুতেই সম্ভবত মানায় না, এ তাদের প্রকৃতিগত সহজাত পোশাক! কী ভয়ানক হাস‍্যকর ইতিহাসবিমুখ কথাবার্তা! পোশাক আবার প্রাকৃতিক হয় কী করে? পোশাক বিষয়টিই তো সভ‍্যতার শুরুর অনেক পরে এসেছে, মানুষ তো পশুপাখির বা গাছের ছালবাকল পরেই থাকতো বলে পড়ে এসেছি! সেইগুলোকে তবু প্রাকৃতিক বললে মানা যেতো এক অর্থে!

শাড়ি পোশাক হিসেবে নান্দনিক, ক‍্যারি করতে পারলে চমৎকার একটি পোশাক, কিন্তু নাতো এটি নারীর জন‍্য বাধ‍্যতামূলক কিছু, না এটি বাঙালীত্বের সূচক। বাঙালী হবার জন‍্য শাড়ি পরা, মাছের মুড়ো চিবোনো, থাবড়াখানিক তেল মাথায় মাখা কোনোটিই গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন‍্যান‍্য সংস্কৃতির মতো বাঙালীর সাহিত‍্য সঙ্গীত কাব‍্য ইতিহাস ভাষা সংস্কৃতি মগজে মননে ধারণ করাই বাঙালীত্ব, যা কিন্তু স্থবির নয়, চলমান। পোশাক সংস্কৃতির একটি অঙ্গ বা অংশ, আবশ‍্যক উপাদান নয় যা বারোমাস বয়ে বেড়াতেই হবে। তা যদি হয় তবে জিনস পরা বাঙালী পুরুষের বাঙালীত্ব‌ও এক‌ই যুক্তিতে নস‍্যাৎ হয়ে যায়! একজন বিদগ্ধ অধ‍্যাপক এইগুলো গুলিয়ে ফেলছেন এটাই দুঃখের। বাঙালী মেয়ে মানেই শাড়ি পরতে হবে, লম্বা চুল রাখতে হবে, বিশাল টিপ পরতে হবে, সে আবার বিবাহিতা হলে শাঁখাপলা নোয়াসিঁদুর শোভিতা হতে হবে…. অনেক তো হলো, এবার একটু অন‍্যভাবে ভাবতে শেখা দরকার মনে হয় না? যাঁরা কিনা মানুষ গড়বেন, মানুষের চিন্তাভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, তাঁরাই যদি এইসব তথাকথিত রোম‍্যান্টিসিজমের সাথে রিগ্রেসিভ ভাবনাচিন্তার চাষবাস চালিয়ে যান, তাহলে এগিয়ে যাবার কথা বলবে কারা?

লেখক পরিচিতি :শীলা চক্রবর্তী 

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব,কলকাতা।

 

Comments are closed.

More News Of This Category